ঢাকা, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৪
সর্বশেষ:

কারবালার প্রেরণা ও শিক্ষা 

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:১৫, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

পৃথিবীর ইতিহাসে নানা কারণে যেসব দিন গুরুত্ব পেয়েছে তার মধ্যে আশুরা অন্যতম। এই দিনে পৃথিবীতে হাজারো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ধর্মীয় দিক দিয়ে এই দিনের গুরুত্ব রয়েছে বেশ। 

বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় আশুরার দিনটিকে পালন করে এক দিকে শোকে কাতর হয়ে, অন্য দিকে অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা নিয়ে। এদিনের প্রেরণায় যদি মুসলিম জাতি উজ্জীবিত হতে পারে তাদের কপালে আর পরাজয়ের তিলক চিহ্ন থাকবে না।

হজরত মুহাম্মাদ (সা.)  এর দৌহিত্র হজরত ফাতিমা তনয় হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) যে পর্বতসম বালা- মুছিবত মাথায় নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে লড়েছেন, তা পৃথিবীতে বিরল। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের অস্তিত্বকে বিলিয়ে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেছেন। সত্যের মহা সৈনিক হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) সামনে এক-এক করে ৭০ জন সাথীবর্গ শহীদ হওয়ার পরও ন্যায়ের পথকেই আগলে ধরেছেন। 

এখন প্রশ্ন হলো, কারবালার উন্মুক্ত প্রান্তরে ৭০ জন শহীদ হলো কেন? নবীজির (সা.) কলিজার টুকরা ইমাম হুসাইনের রক্তে রঞ্জিত হলো কেন কারবালা ধু ধু উত্তপ্ত মরুপ্রান্তর? মিজানুল ইতেদাল ও তাহসিবুত তাহসিব বরাতে একথা প্রতিভাত হয়, ইতিহাসও একথার পক্ষে সাক্ষ্য দেয় হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ওই দিন রক্তপাত এড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তিনি যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া নিজের শক্তিমত্তার পরিচয়ের জন্য কিংবা ক্ষমতার মসনদের জন্য অসি হাতে নিয়ে নেননি; কিন্তু ঝটিল পরিস্থিতি তা নিতে বাধ্য করে। তিনি দ্বন্দ এড়ানো কল্পে তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন-  

১. আমি যেখান থেকে এসেছি সে খানে ফিরে যেতে দেয়া হোক। 
২. আমাকে ইয়াজিদের দরবারে সশরীরে গিয়ে কথা বলার সুযোগ দেয়া হোক এবং আমার আর তার মাঝে যে সন্ধি হবে তা-ও মেনে নিতে হবে। 
৩. অথবা কোনো মুসলিম জনপদের সীমান্ত এলাকায় যেতে দেয়া হোক, আমি সেখানে দিনাতিপাত করব। মোট কথা, হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কোনোভাবেই রক্তপাত চাননি। শুধু তাই নয়, হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ওই দিন সাথীদের বলেছিলেন, তোমরা রাতের অন্ধকারে কোনো নিরাপদ স্থানে চলে যাও; আমি তোমাদের কোনো কিছু বলব না। তোমাদের সমালোচনাও করব না। আমি আমাদের ভাগ্যে বিপদের ঘনঘটা লক্ষ করেছি। শত্রুরা শুধু আমাকেই হত্যা করতে চায়। আমাকে হত্যা করতে পারলে তাদের আর কারোর প্রয়োজন নেই। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) সে দিনের সে আপসহীনতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ‘প্রয়োজনে শির দেব তবুও নিজের পবিত্রতা ও ঈমানী হাত বাতিলের কাছে সোপর্দ করব না’ নীতি দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে গেছেন। আমরা সেই নীতি থেকে বহু দূরে সরে গেছি। 

আমরা আজ কারবালার দিবসে হায় হোসাইন! হায় হোসাইন! বলে চিৎকার মাতামাতি মাতম ও শোক র‌্যালি বের করি। আর এগুলো পালনের মধ্য দিয়ে ভাবি কারবালার শিক্ষা হোসাইনের আত্মদান হাসিল হয়ে গেছে। অথচ কারবালার শিক্ষা এটা ছিল না। কারবালার শিক্ষা ছিল হোসাইনি চেতনায় জেগে উঠা। হোসাইনী চেতনার ভিত্তিতে ঈমান ও আমলের পশরা সজানানো। ফিরনী শিরনী আর শোক র‌্যালি করে দায়িত্ব মুক্তি হবে না।

বিশ্বব্যাপী বর্তমান মুসলিম উম্মাহার এই নাজুক পরিস্থিতি হজরত ইমাম হোসাইনের (রা.) সেই অনুসৃত নীতি কেই আঙুল দিখিয়ে দেয়। দেশে দেশে কেন আজ মুসলিমরা নিপীড়িত নিগৃহীত লাঞ্ছিত? বার্মা, আরাকান, আফগান, চেচনিয়া, নাইজেরিয়া, চীন রক্তাক্ত জনপদের নাম। কেন মুসলিম বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি আয় উন্নতি সর্বক্ষেত্রে পশ্চিমাগোষ্ঠীর মোড়লিপনা?  

মুসলিম জাতির রাজনীতি নামে যে নীতি ছিল তা ছিল বিশ্বকে অবাক করার মতো সুন্দর। যে মুসলিম জাতির অর্থনীতিতে কখনো ধ্বস নামার কথা ছিল না, যে অর্থ ব্যবস্থা জগতকে চমকিয়ে দিয়ে ছিল অল্পকদিনে। বিশ্বের বড় বড় বন্দরে মুসলমানদের বাণিজ্য জাহাজ নোঙ্গর করত, সেই মুসলিম জাতি আজ অন্যের পণ্যের ক্রেতা! 

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজনীতি ছিল মুসলিম জাতির। কোথায় সে তার আত্মমর্যাদা হারিয়েছে। ১৪৪১ হিজরি আশুরার দিবসে বাস্তবতার নিরিখে প্রশ্নগুলো অবলীলায় হৃদয়ে ভিড় জমায়। কবি ইকবাল, মুসলমানদের ওই দৈন্যদশা দেখে বড় আক্ষপের সুরে বলেছিলেন, মুসলিম জাতি আজো ঘুমন্ত অবস্থায় আছে, অথচ ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে জাগ্রত করার জন্য ৬১ হিজরিতে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের পবিত্র রক্ত কারবালার জমিনে ঢেলে দিয়ে গেছেন।

আল্লামা ইকবাল মরহুম হোসাইনি চেতনার মেসেজ দিয়েছেন এভাবে- ওই দিন ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের তাজা রক্তকে কালি বানিয়ে কারবালার উত্তপ্ত বালুকণাকের খাতায় বানিয়ে আগামীর অনাগত পৃথিবীকে একথা জানিয়ে দিলেন যে দেখ, ওহে মুসলিম সমাজ, সমাজপতি ও ক্ষমতাধরেরা বুঝে নাও; রক্ত লাগলে রক্ত দিতে প্রস্তুত থাকবে, জীবন লাগলে জীবন দিতে প্রস্তুত থাকবে, তবুও অন্যায় অত্যাচার জুলুম নির্যাতনের কাছে মাথা নত করা যাবে না। আজ সেই হোসাইনী চেতনার বড়ো অভাব আমাদের মাঝে।

আশুরা আসে যায়। আশুরার আনুষ্ঠানিকতাও পালন হয়। তবে হয় না শুধু কারবলার শিক্ষা নেয়া। ৬১ হিজরি ১০ই মহাররম থেকে ১৪৪১ হিজরির ১০ মহাররম পর্যন্ত সময়গ্রন্থি আওয়াজ দিচ্ছে- হে মুসলমান জাতি তোমরা কবে জাগ্রত হবে? আর কতো হোসাইনির রক্ত লাগবে?

লেখক: হাবীবুল্লাহ সিরাজ 

নিউজওয়ান২৪.কম/এমজেড